কৃষি ও কৃষক বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য সহায়ক। শাকসবজিতে সাধারণত বিভিন্ন খনিজ লবণ এবং ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে থাকে। এ জন্য শাকসবজিকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। এতে ক্যালরির ও আমিষের পরিমাণ খুব কম। গাঢ় হলুদ ও সবুজ শাকসবজিতে বেশি পরিমাণে ক্যারোটিন বা প্রাক ভিটামিন ‘এ’ থাকে যা খাওয়ার পর ক্ষুদ্রান্তে ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন খাবারের সাথে সবজির ব্যবহার জনপ্রিয় করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে চাষকৃত প্রচলিত অপচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি যার মধ্যে ৩০-৩৫টিকে প্রধান সবজি ধরা যায়। দেশে জমিতে যে পরিমাণ সবজি চাষ করা হচ্ছে তার মাধ্যমে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম (সূত্র : এফএও, ডিএই) সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্য তালিকায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য মানবদেহের অতীব প্রয়োজনীয় দুটি খাদ্য উপাদান বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিন এর সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস হলো বিভিন্ন প্রকারের সবজি। বাংলাদেশে অপুষ্টি একটি অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সুষম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি গুরুত্ব ভূমিকা রাখতে পারে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদন করার মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা মিটানো সম্ভব।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। সবজি চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া অনেকেই অতি লাভের আশায় বাজারে বিক্রির জন্য সবজির মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকার জন্য নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, উপযুক্ত সময় ও নির্ধারিত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে সবজি সংগ্রহের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১০.৩৪২ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ করা হয়। যেখান থেকে ২১৬.৭০ লাখ মে. টন সবজি উৎপাদিত হয়। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে আলুসহ সবজির উৎপাদন ছিল ৮১.৭৭ লাখ মেট্রিক টন, বর্তমানে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বেড়ে প্রায় ৩২৪.৪১৭ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। প্রবৃদ্ধির হার ৭৪৯%। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি করছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশ বর্তমানে সবজি উৎপাদনে বিশ্বে ৩য় এবং আলু উৎপাদনে বিশ্বে ৮ম। বিগত ৫ বছরে বাংলাদেশের সবজি ও কন্দাল ফসলের উৎপাদনের তথ্যাবলি (সারণি দ্রষ্টব্য)।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে দেশে কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে সারা বছরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারাদেশে বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান; নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কলাকৌশল হাতে-কলমে দেখানো; নিরাপদ সবজি উৎপাদনের প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুুদ্ধকরণ; জৈব কৃষি তথা ফেরোমন ফাঁদ, আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) ইত্যাদি কৌশলের মাধ্যমে যথাসম্ভব বালাইনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করা; সঠিক সময় ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা; বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন সম্পর্কে কৃষককে পরামর্শ প্রদান।
সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি জন্য সবজি চাষে রাসায়নিক সারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও পোকামাকড় দমন ও রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য নানারকম বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া জমিতে জৈবসার, কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশকের ক্ষেত্রে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে না। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে যে সকল বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তা হচ্ছে-
উচ্চমূল্যের ফসলের চাষ : উচ্চমূল্যের ফসল সারা বছর চাষের মাধ্যমে বছরব্যাপী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং দরিদ্রতা দূর করে। উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে গ্রীষ্মকালীন শিম, মরিচ, পেঁপে, মাশরুম চাষ করা যায়।
সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ : সাধারণত যে জমি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় বা বছরের বেশির ভাগ সময় পানি জমে থাকে সে জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যায়। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝের মাটি কেটে উঁচু বেড তৈরি করে ফসল চাষ করাই সর্জান পদ্ধতি। মধ্য জানুয়ারি থেকে মাধ্য মার্চ (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে সর্জান বেড তৈরি করা যায়। প্রায় ২৮ মিটার লম্বা এবং ১১ মিটার চওড়া একখ- জমিতে ১০ঢ২ বর্গমিটার আকারের ৫টি বেড তৈরি করা যেতে পারে। বেডের উচ্চতা কমপক্ষে ১ মিটার হলে ভালো হয়। সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে বছরব্যাপী পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ : জলবায়ু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বন্যা/জলমগ্ন অবস্থার সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য কৃষকরা স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উদ্ভাবিত ভাসমান কৃষি পদ্ধতিতে (যা স্থানীয়ভাবে ভাসমান/ধাপ চাষ নামে পরিচিত) কমপক্ষে প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে ফসল উৎপাদন করে আসছে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পশ্চিমাঞ্চলের গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর এবং বরিশাল জেলায় বর্ষাকালে নিচু জলমগ্ন এলাকাসমূহে মূলত ভাসমান চাষ করা হয়। গোপালগঞ্জ জেলার সকল উপজেলা এবং বরিশালের উজিরপুর ও আগৈলঝড়া উপজেলায় শুধু কচুরিপানা, দুলালীলতা, টোপাপানা দিয়ে তৈরি ভাসমান বেডে শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসলের চারা উৎপাদন করে পার্শ্ববর্তী এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর নিচু থেকে অতি নিচুভূমি আছে যা দেশের মোট আয়তনের ২১% (বিএআরসি,২০০৬)। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ০.২৫ মিলিয়ন হেক্টর প্লাবিত ভূমি রয়েছে। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে যার আয়তন প্রায় ৮.৫৮ লাখ হেক্টর। বর্ষাকালে প্লাবন/জলমগ্নতার কারণে এ সকল ভূমির একটা বড় অংশ অনাবাদি বা পতিত থাকে। গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত ও লাগসই ভাসমান কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব প্লাবিত পতিত ভূমি সহজেই ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তিটি পরিবেশবান্ধব এবং বাংলাদেশের পরিবর্তিত জলবায়ুগত পরিস্থিতিতে কৃষি অভিযোজনের জন্য উপযোগী।
ছাদ কৃষি : গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ টাটকা শাকসবজি গ্রহণের সুযোগ পেলেও শহরের বিপুল জনগোষ্ঠী সেই সুযোগ থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। তাই ছাদ বাগানে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে নগরজীবনে সারা বছরের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। শহরের ভবনগুলোতে ছাদবাগান স্থাপনের ফলে একদিকে যেমন শহরের জনগণ টাটকা ও নিরাপদ সবজি খেতে পারছে অন্যদিকে এটি ভবনের অতিরিক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে।
মাশরুম চাষ : মাশরুম বাংলাদেশে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, পুষ্টিকর, সুস্বাস্থ্য ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন সবজি, মাশরুম একটি স্বল্প ক্যালরিযুক্ত খাবার হলেও এতে রয়েছে অতি উন্নতমানের আমিষ যা কোন উদ্ভিদজাত খাবারে তো নয়ই, অনেক প্রাণীজ আমিষের থেকেও দুষ্কর। তাই মাশরুম মানসম্পন্ন আমিষের একটি বিকল্প উৎস হিসেবে বিবেচিত। বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের বৈচিত্র্য সেই সাথে নানা ধরনের ঔষধিগুণের সমারোহের কারণে সবজি হিসেবে মাশরুম অনন্য। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি হিসেবে সারা বছর মাশরুম চাষের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
শস্যের বৈচিত্র্যতা তথা কৃষি উন্নয়নের প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকল্পে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বছরব্যাপী সবজি উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনকে ভবিষ্যৎ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে মিল রেখে বিভিন্ন মেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অংশীজনের অংশগ্রহণে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এরই মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। দেশ ও জাতি পাবে স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী সুনাগরিক।
উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয়
পাথরঘাটা, বরগুনা।